শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৪ অপরাহ্ন
মল্লিক জামান, (বাগেরহাট)থেকেঃ নিউজ দৈনিক ঢাকার কন্ঠ
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠাপ্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য লীলা ভুমি সুন্দরবন। ম্যাগ্রোভ সুন্দরবনকে প্রাকৃতিকসৌন্দর্যের লীলাভূমি বলা হয়। ‘রয়েলবেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রা হরিণসহ ৩৭৫প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলওসুন্দরবন। এছাড়া দেশের প্রাকৃতিকদুর্যোগের বিরুদ্ধে দেয়াল হিসেবে দাঁড়িয়েআছে সুন্দরবন। বিভিন্ন সময়ে সুপারসাইক্লোন নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়েউপকূলবাসীকে রক্ষা করেছে মায়ের মত।
তবে উপকূলের কোটি-কোটি মানুষকেনিরাপদে রাখলেও সুন্দরবন এখন নিজেইভালো নেই। জলবায়ু পরিবর্তন,পানিরউচ্চতা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, বন্যপ্রাণীশিকারি ও কাঠ পাচারকারীদের কারণেপ্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে সুন্দরবন।এদিকে বনবিভাগ বলছে, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট প্যাট্রোলিংসহ সুন্দরবনেরপ্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়াহয়েছে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বনের মধ্যেআঁকা-বাঁকা নদী, খাল ও তিন নদীর মোহনারয়েছে সতেরশো বর্গকিলোমিটার। দেশেরসমগ্র সংরক্ষিত বনভূমির অর্ধেকেরও বেশিঅর্থাৎ ৫১ শতাংশ বনই হচ্ছে সুন্দরবন।প্রায় ৬ হাজার ১১৭ বর্গ কিলোমিটারআয়তনের এ বনে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা।
রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। নদ-নদীতেরয়েছে বিলুপ্তপ্রায় তালিকায় থাকাইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন ও ২১০প্রজাতির মাছ। রয়েল বেঙ্গল টাইগারেরবিষয়ে বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপেসুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। ১৯৮২ সালেরজরিপে দেখা যায় বাঘের সংখ্যা ৪২৫টি।১৯৮৪ সালে সুন্দরবনের ১১০বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথাজানানো হয়।
২০১৮ সালে করা একটি জরিপেরফলাফলে বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে১১৪টি। ২০১৫ সালে ‘ক্যামেরা ট্র্যাকিং’পদ্ধতিতে পরিচালিত জরিপে বাঘের সংখ্যাবলা হয়েছে ১০৬টি। ২০০৪ সালেরজরিপের তথ্য অনুযায়ী ৪৪০টি বাঘেরমধ্যে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায়৮৯টি পুরুষ, ১৭০টি স্ত্রী এবং ১২টি বাঘশাবক, বাগেরহাটের চাঁদপাই ও শরণখোলারেঞ্জ এলাকায় ৩২টি পুরুষ, ১২৮টি স্ত্রীএবং ৯টি বাঘ শাবকের অবস্থান জরিপেউল্লেখ করা হয়েছিল। অর্থাৎ দেড় যুগেরওকম সময়ের ব্যবধানে ৩২৬টি বাঘ কমেছেসুন্দরবনে। আর কয়েক বছরে বেড়েছেমাত্র ৮টি বাঘ। তবে বর্তমানে সুন্দরবনেরবাঘের আনাগোনা বাড়ছে।
সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায়বাঘের অবাধ বিচরণ ও প্রতিনিয়ত বাঘেরশাবকের দেখা মিলছে বলে জানানসুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালিরা। হরিণশিকারের বিষয়ে স্থানীয়দের সাথে কথাবলে জানা যায়, সুন্দরবনে আবারওবেপরোয়া হয়ে উঠেছে হরিণ শিকারিরা।তারা বনের মধ্যে ফাঁদ পেতে ও গুলি করেচিত্রা ও মায়া হরিণ শিকার করছে।
সংঘবদ্ধ চোরা শিকারিরা সুন্দরবনেরগহীনে হরিণ বিচরণের স্থান সমূহে ফাঁদপেতে হরিণ শিকার করে। কখনো তারাগুলি ছুড়েও শিকার করে। পরে গোপনআস্তানায় মাংস তৈরি করে সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে।সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা, শরণখেলা, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছাসহ বনের আশপাশএলাকায় সবচেয়ে বেশি হরিণের মাংসপাওয়া যায়। এভাবে হরিণ শিকার করেবিক্রি করতে গিয়ে অনেকে ধরাও পড়েনআইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে।
সর্বশেষ গত ৯ ফেব্রুয়ারি মোংলাউপজেলার ঢাংমারি এলাকায় অভিযানচালিয়ে ৪২ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করেকোস্টগার্ড পশ্চিম জোন, মোংলারসদস্যরা। অপরদিকে সুন্দরবনেরআশপাশের নদী-খালে বিষঠ দিয়ে মাছশিকার বন্ধ করতে না পারায় সুন্দরবনেরমৎস্য খ্যাত ভাণ্ডার নদী-খাল ক্রমশ-ই মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। বিষ দেওয়ার ফলে শুধুমাছ-ই নয় মারা যাচ্ছে অন্যান্য জলজপ্রাণীও।
এতে একদিকে বিরূপ প্রভাব পড়ছেবনজট সম্পদসহ পরিবেশের ওপরঅন্যদিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে বাগেরহাটেরউপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের। এইঅবস্থায় জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদসুরক্ষায় দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবীজানান বনের সাথে সংশ্লিষ্টরা। তবেসুন্দরবন জুড়ে এ পরিস্থিতি থেকেউত্তরণের জন্য বন বিভাগ, কোস্টগার্ড,র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযানঅব্যহত রয়েছে। কিন্তু এতেও দৌরাত্ম্যকমছে না অসাধু জেলে-ব্যবসায়ীদের।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনেরচেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলামপ্রতিবেদককে বলেন, সুন্দরবনের সৌন্দর্যহলো বন্যপ্রাণী। সেই বন্যপ্রাণী যারা নিধনকরে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোরআইনের দাবী জানিয়ে আসছি। কিন্তুকঠোর আইন না থাকায় প্রচলিত আইনেরফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে তারা পুনরায়সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী নিধনে লিপ্ত হয়। তিনিআরো বলেন, বাঘ ও সুন্দরবনের বন্য প্রাণীরক্ষায় সরকার সুন্দরবনের ৫২ শতাংশবনভূমিকে অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত বনভূমিহিসেবে ঘোষণা করেছে। সংরক্ষিতবনাঞ্চলের যে শর্ত, তা সঠিকভাবেবাস্তবায়ন করতে পারলে বাঘের প্রজননবাড়বে। প্রজনন বাড়লে বাঘও বাড়বে।
সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়কনজরুল ইসলাম আকন বলেন, প্রভাবশালীসিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় একশ্রেণির জেলেনৌকা ও ট্রলার নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকেবিষ দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এতে শুধুমাছ নয়, পানি বিষাক্ত হয়ে অন্যান্য জলজপ্রাণীও মারা যাচ্ছে। বিষ দিয়ে মাছ শিকারকরায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্তহচ্ছে। বাঘসহ বন্য প্রাণী রক্ষায় সাধারণমানুষকেও সোচ্চার হতে হবে। বন্য প্রাণীহত্যা, ক্রয়-বিক্রয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেহবে বলে জানান তিনি।
বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে খাদ্যচক্রেওব্যাপক প্রভাব পড়ে বলে জানান, খুলনাবিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদেরপ্রভাষক রাবেয়া সুলতানা। তিনি বলেন, এসব কীটনাশক যেখানে প্রয়োগ করা হয়, সেখানে ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ মারাযায়। মাছের পাশাপাশি জলজ উদ্ভিদও (মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য কণিকা) মারাযাচ্ছে। ফলে খাদ্য সংকট তৈরি হচ্ছে। আরএর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক খাদ্য চক্রেরউপরে। কিন্তু যদি প্রাকৃতিক উপায়ে মাছধরা হয় তাহলে খাদ্য চক্রের উপরে খুববেশি প্রভাব পড়ে না বলে জানান তিনি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানঅনুষদের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুনচৌধুরী।
মল্লিক জামান
রামপাল, বাগেরহাট।
১৬/০২/২০২২